ইসলামের মৌলিক বিষয় কয়টি তাদের শরিয়াহ তথা ইবাদাত-বন্দেগি ও আইন-কানুনে কিছুটা পার্থক্য ছিল। সকল নবী-রাসূলের মধ্যে সর্বশেষ রাসুল হচ্ছেন আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর পরে আর কোনো নবী বা রাসুল নেই। আমরা পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসুলকেই স্বীকৃতি দেবো, তবে আমল করব আমাদের নিকট প্রেরিত রাসুলের শরিয়তের আলোকে।
ইসলামের মৌলিক বিষয় ৫ টি। বিষয়গুলো হলোঃ
০১. ইমান বা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস।
০২. নামাজ
০৩. জাকাত
০৪. রোজা বা সাওম
০৫. হজ্ব
আর ইমানের মৌলিক বিষয় ৭ টিঃ
০১. আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করা
০২. ফেরেশতা নামে আল্লাহর এক সৃষ্টি আছে তা বিশ্বাস করা
০৩. আল্লাহর নাজিলকৃত আসমানী কিতাবসমুহকে বিশ্বাস করা
০৪. আল্লাহর রাসুলগণকে বিশ্বাস করা
০৫. কিয়ামতের দিবসকে বিশ্বাস করা
০৬. ভালো-মন্দ সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে হয় তা বিশ্বাস করা
০৭. কিয়ামতের দিবসে পুনরায় জীবিত হওয়াকে বিশ্বাস করা
ইসলামের মৌলিক বিষয় কয়টি
মহান আল্লাহ বলেন:
لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآَخِرِ وَالْمَلائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآَتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآَتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ
‘পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোর মধ্যে কোনো পুণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য তার যে বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহর প্রতি, পরকালের প্রতি, ফেরেশতাগণের প্রতি, কিতাবসমূহে ও নবীগণের প্রতি এবং ধন-সম্পদের প্রতি মনের টান থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন-অনাথ, অভাবগ্রস্ত, পথিক, সাহায্য প্রার্থনাকারীগণকে ও দাসমুক্তির জন্য অর্থ ব্যয় করে, এবং সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূর্ণ করে আর অর্থ-সংকটে, দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য্য ধারণ করে। এরাই প্রকৃত সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাকী।’ [সূরাহ বাকারা: ১৭৭]
ইসলামের ভিত্তি কয়টি এবং কী কী একটি হাদিসে এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেন,
وَعَنِ ابنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنهُمَا، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: «بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلٰهَ إلاَّ اللهُ، وَأَنَّ مُحَمَّداً رَسُولُ اللهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَحَجِّ البَيْتِ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ». متفقٌ عَلَيهِ
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের উপর প্রতিষ্ঠিত। (১) এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসূল। (২) নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। (৩) যাকাত প্রদান করা। (৪) কা‘বা গৃহের হজ করা। (৫) রমযান মাসে রোযা পালন করা।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬]
১) ঈমান।
আমরা জানি, বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়ে ইসলাম। সঠিক বিশ্বাস বা ঈমানই ইসলামের মূল ভিত্তি। আমরা যত ইবাদত ও সৎকর্ম করি সবকিছু আল্লাহর নিকট কবুল বা গ্রহণযোগ্য হওয়ার শর্ত ঈমান।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّه
‘ঈমান হলো এই যে, তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর গ্রন্থসমূহে, তাঁর রাসূলগণে ও শেষ দিবসে (আখিরাতে) এবং বিশ্বাস করবে আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরের (ভাগ্যের) ভাল ও মন্দে।’
[সহীহ মুসলিম: ১/৩৫-৩৬]
এভাবে বিভিন্ন আয়াত ও হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, ইসলামের মৌল বিশ্বাস বা ‘আল-আকীদাহ আল ইসলামিয়্যাহ’-র ছয়টি মৌলিক স্তম্ভ রয়েছে—
১. আল্লাহর ওপর ঈমান,
২. আল্লাহর ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমান
৩. আল্লাহর নাযিল করা কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান,
(৪) আল্লাহর রাসূলগণের ওপর ঈমান,
(৫) পুনরুত্থান, কিয়ামত, পরকাল বা আখিরাতের ওপর ঈমান, এবং
(৬) তাকদীর বা আল্লাহর নির্ধারণ ও সিদ্ধান্তের ওপর ঈমান। এ বিষয়গুলোকে আরকানুল ঈমান, অর্থাৎ ঈমানের স্তম্ভসমূহ, ভিত্তিসমূহ বা মূলনীতিসমূহ বলা হয়।
ঈমানের রুকন বা মূল ভিত্তি গুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলঃ
১) আল্লাহর উপর ঈমান
আল্লাহর উপর ঈমানের মূলকথা হল তাওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদের উপর ঈমান আনা। তাওহিদকে বোঝার সুবিধার্থে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়। ক) রুবুবিয়্যাহ, খ) উলুহিয়্যাহ, গ) আসমা ওয়াস সিফাত। এই তিন ক্ষেত্রেই আল্লাহর কোনো শরীক নেই।
ক) রুবুবিয়্যাহঃ সৃষ্টি, প্রতিপালন, রিযিক প্রদান, সুস্থতা, জীবন ও মৃত্যু দানসহ মহাজাগতিক যত বিষয় রয়েছে, তাতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও বিন্দুমাত্র ক্ষমতা নেই। অনুরুপভাবে, শরিয়াহ বা জীবনবিধান প্রদান, শাসন কর্তৃত্ব, সার্বভৌমত্ব এসবই আল্লাহর একচ্ছত্র অধিকারে।
খ) উলুহিয়্যাহঃ ইবাদাত ও আনুগত্য সংক্রান্ত যত বিষয় রয়েছে এসবেরই একচ্ছত্র অধিকারী আল্লাহ তা’আলা। যেমনঃ ইসলাম তথা আত্মসমর্পণ করা; ইহসান তথা নিষ্ঠার সাথে কাজ করা, দয়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন, উপকার সাধন করা; দু’আ তথা প্রার্থনা, আহ্বান করা; খওফ তথা ভয় করা; তাওয়াক্কুল তথা নির্ভরশীলতা; খুশু তথা বিনয়, নম্রতা; খাশিয়াত তথা অমঙ্গলের আশংকা;
ইনাবাহ তথা আল্লাহর অভিমুখী হওয়া, তাঁর দিকে ফিরে আসা; ইস্তি’আনাহ তথা সাহায্য প্রার্থনা করা; ইস্তি’আযাহ তথা আশ্রয় প্রার্থনা করা; যাবাহ তথা কুরবানি বা উৎসর্গ করা; নাযর তথা মান্নত করা ইত্যাদি সকল কিছু হতে হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য।
গ) আসমা ওয়াস সিফাতঃ এর অর্থ নাম ও গুণাবলির ক্ষেত্রে আল্লাহ এক। এটির মূল কথা হচ্ছে, কুরআন ও সুন্নাহয় আল্লাহ তা’আলার যেসমস্ত নাম ও গুণের বর্ণনা এসেছে, সেগুলো কোনো প্রকার বিকৃতিকরণ, ধরণ বর্ণনা, আকৃতি নির্ধারণ, সাদৃশ্য প্রদান ব্যতীত ঈমান আনা। এ সমস্ত নাম ও গুণের ওসিলায় আল্লাহর নিকট দু’আ করা।
আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ আল্লাহর একত্বে বা তাওহীদে বিশ্বাস করা। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর প্রতি ঈমানের বর্ণনা দিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ- وفي رواية: شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، وفي رواية ثالثة: أَنْ يُوَحَّدَ اللَّهُ، وفي أخرى: أَنْ يُعْبَدَ اللَّهُ وَيُكْفَرَ بِمَا دُونَهُ- وَإِقَامِ الصَّلاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَانَ، وفي رواية: صيام رمضان والحج
‘ইসলামকে পাঁচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, তা হলো— বিশ্বাসের সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা‘বুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, (অন্য বর্ণনায় রয়েছে: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা এবং আল্লাহ ছাড়া যা কিছু (উপাস্য) আছে সবকিছুকে অবিশ্বাস করা), সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রামাদান মাসের সিয়াম (রোযা) পালন করা, বাইতুল্লাহর হজ্জ আদায় করা।’ [সহীহ বুখারী: ১/১২, ৪/১৬৪১; সহীহ মুসলিম: ১/৪৫]
২) ফেরেশতাদের উপর ঈমান
ফেরেশতারা আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি। তাদের সৃষ্টি নুর দিয়ে। তারা মানবীয় সমস্ত দুর্বলতার ঊর্ধ্বে। তাদের মর্যাদার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। তারা আল্লাহর ক্ষমতায় অংশীদার নন, বরং তাঁর হুকুমের অনুসরণকারী মাত্র। আল্লাহর হুকুমের ব্যত্যয় করার সামর্থ্য তাদের নেই।
৩) কিতাবসমূহের উপর ঈমান
আল্লাহ তা’আলা মানুষের পথপ্রদর্শনের লক্ষ্যে যুগে যুগে নবী-রাসুলদের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। তাতে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের আকিদা-ইবাদাত সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়দির পথনির্দেশনা ছিল। সমস্ত কিতাব ও সহিফার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। বিশেষ করে চারটি প্রধান কিতাবের প্রতি। তবে সকল কিতাবের মধ্যে একমাত্র কুরআনকেই আল্লাহ তা’আলা সার্বজনীন ও সামগ্রিক হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
৪) নবী-রাসুলগণের উপর ঈমান
নবী-রাসুলগণের উপর ঈমানের অর্থ হলো, এই বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য তাদের মধ্য হতে একজনকে নবী বা রাসুল হিসেবে পাঠিয়েছেন। সকল নবীই সত্যবাদী, সত্যায়নকারী, পুণ্যবান, সঠিক পথের দিশারী, তাকওয়াবান ও বিশ্বস্ত ছিলেন। আল্লাহ তাঁদেরকে যা কিছু দিয়ে প্রেরণ করেছেন তারা তা পরিপূর্ণভাবে তাদের সম্প্রদায়ের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। কোন অংশই তাঁরা গোপন করেননি বা পরিবর্তন করেননি। ওহির মধ্যে নিজ থেকে তাঁরা কোনো সংযোজন বা বিয়োজনও করেননি। সমস্ত নবি-রাসুলদের দাওয়াতের মূল বিষয়ই ছিল তাওহিদ। কিন্তু
৫) আখিরাতের উপর ঈমান
পরকালের উপর ঈমানের অন্তর্ভুক্ত হলো, মৃত্যু ও এর পরবর্তী জীবন, কবরের শাস্তি ও শান্তি, পূনরুত্থান, হাশর, মিযান, শাফায়াত, হাওজে কাওসার, পুলসিরাত, জান্নাত-জাহান্নাম ও মহান রবের দিদারসহ কুরআন ও সুন্নাহয় বিবৃত পরকাল সংক্রান্ত বিষয়াবলির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। শুধু বিশ্বাসেই এটি সীমাবদ্ধ নয়, বাস্তব জীবনেও এর প্রতিফলন জরুরি। বস্তুত আখিরাতে বিশ্বাস এমন একটি ব্যাপার যা ব্যক্তির মাঝে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়।
৬) তাকদিরের ভালো-মন্দের উপর ঈমান
তাকদির মহান রবের এক রহস্য। আল্লাহ তা’আলার আদল ও ইনসাফের দিকে খেয়াল রেখে আমাদের উচিত তাকদিরের প্রতি অকুন্ঠ বিশ্বাস স্থাপন করা। আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টা, সমস্ত কর্মেরও স্রষ্টা। তিনি মানুষকে সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বেই তার তাকদির নির্ধারণ করেছেন। দুনিয়াতে মানুষকে প্রাথমিক ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, ভালো-মন্দ উভয়টি বান্দাকে জানিয়ে দিয়েছেন, এরপরও চূড়ান্তভাবে কোনো কিছুই আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে নয়। মানুষ সসীম, মানুষের চিন্তাশক্তিও সসীম, আর আল্লাহ হলেন অসীম। আর সসীম দিয়ে অসীম কোনো কিছুকে কখনও আয়ত্ব করা যায় না।
ঈমান
ইসলামের প্রথম স্তম্ভ ঈমান। প্রতিটি মুসলমানের প্রথম দায়িত্ব ঈমান আনা। ঈমান শব্দের অর্থ বিশ্বাস। প্রতিটি মুসলমানকে বিশ্বাস করতে হয় আল্লাহ একমাত্র উপাস্য এবং মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসুল। তবে হাদিসে ঈমানের বিস্তারিত পরিচয় বর্ণিত হয়েছে এভাবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে হজরত জিবরাইল (আ.) একবার ছদ্মবেশে এসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন,
‘ঈমান কাকে বলে?’ জবাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘ঈমান হচ্ছে- আপনি বিশ্বাস স্থাপন করবেন আল্লাহ তায়ালার প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, আসমানি কিতাবগুলোর প্রতি, আল্লাহর নবী-রাসুলদের প্রতি, কেয়ামত দিবসের প্রতি এবং তকদিরের ভালো ও মন্দের প্রতি। এই হলো ঈমান।’ (বুখারি: ৫০)। ঈমানের এই ছয়টি বিষয়কে ইসলামের পরিভাষায় ‘ঈমানে মুফাসসাল’ অর্থাৎ ‘ঈমানের বিস্তারিত পরিচয়’ বলা হয়।
২) নামাজ।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের দ্বিতীয়টি হলো নামাজ। আল্লাহর প্রতি ইমান আনার পর মুমিন বান্দাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যপালনীয় ইবাদত হচ্ছে নামাজ। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার ওপর নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা ফরজ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা বিশ্বাসীদের জন্য ফরজ করা হয়েছে।’
নামাজই একমাত্র ইবাদত; যার মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার সব কাজ ছেড়ে শুধু আল্লাহর জন্য নিবেদিত হয়ে যায়। এ নামাজই মানুষকে দুনিয়ার সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে ধুয়েমুছে পাক-সাফ করে দেয়। দুনিয়ার সব অন্যায়-অনাচার থেকে হেফাজত করে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, (হে আল্লাহর রাসুল!) আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় আমল কোনটি? রাসুল (সা.) বললেন, “নামাজ” (বুখারি ও মুসলিম)।’ রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দেয়, আল্লাহ তাআলা তার থেকে নিজের জিম্মাদারি উঠিয়ে নেন।’ (বুখারি-১৮, ইবনে মাজাহ-৪০৩৪, মুসনাদে আহমদ-২৭৩৬৪)।
শবে মিরাজের ঘটনা হলো মহান আল্লাহর সঙ্গে নবীজির সাক্ষাৎ। নামাজ বিশ্বাসীদের কাছে মিরাজ। যার মাধ্যমে মানুষ সুযোগ পায় সর্বশক্তিমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা দিদার। নামাজ বান্দা ও আল্লাহর মধ্যে সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার সেতুবন্ধ। আগে থেকেই বিভিন্ন সময়ে নামাজের প্রচলন থাকলেও ফরজ বা অবশ্য করণীয়ভাবে মিরাজের সময় থেকে পূর্ণতা পায়। নবী করিম (সা.) সব মানুষের জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক ইবাদতের ব্যবস্থা হিসেবে উপহার পেয়েছিলেন। রাসুল (সা.) মিরাজে গমন করেন।
সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ নির্ধারিত হয়। পরে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নামাজের সময় ও পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। নামাজ পাঁচ ওয়াক্তে বা সময়ে পড়তে হয়। এগুলো হলো ফজর, জোহর, আসর, মাগরিব, এশা। শুক্রবারে জুমার নামাজ। আর ফরজে কিফায়া হলো জানাজার নামাজ।
সুরা জুমার ১০ নম্বর আয়াতে আছে, তোমরা নামাজ আদায় করার পর জমিনে ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহর দেওয়া জীবিকা অন্বেষণ করো এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।
নামাজ
ঈমান আনার পর মুসলমানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি মুসলমানকে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হয়। ভোরে ফজরের দুই রাকাত, দুপুরে জোহরের চার রাকাত, বিকালে আসরের চার রাকাত, সন্ধ্যায় মাগরিবের তিন রাকাত ও রাতে এশার চার রাকাত- এই সতেরো রাকাত নামাজ পড়া ফরজ। এ ছাড়া ওয়াজিব, সুন্নত, নফল নামাজ রয়েছে।
সেগুলোও নিয়মিত আদায় করা উচিত। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করা মুমিনদের জন্য ফরজ করা হয়েছে।’ (সুরা নিসা : ১০৩)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় আমল কোনটি? রাসুল (সা.) বললেন, ‘নামাজ’। (বুখারি ও মুসলিম)।
আরও বলেন, ‘যে ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দেয়, আল্লাহ তার থেকে দৃষ্টি উঠিয়ে নেন।’ (বুখারি : ১৮)। নবুয়তের দশম বছর পবিত্র মেরাজের রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়। ইচ্ছাকৃত নামাজ ত্যাগ করা কবিরা গুনাহ। অস্বীকার করা কুফুরি।
৩) রোজা।
ইসলামের পঞ্চ-স্তম্ভের অন্যতম একটি হলো রোজা। মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করেছেন।
রোজা শুধু আমাদের ওপর ফরজ করেছেন তা কিন্তু নয় বরং আমাদের পূর্ববর্তী সবার ওপরই রোজার বিধান ছিল। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ءَامَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের আগের লোকেদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)।
রমজানের রোজার পালনের নির্দেশমদিনায় দ্বিতীয় হিজরির ১০ শাবান মুমিন মুসলমানের ওপর রমজানের রোজা ফরজ হয়। আল্লাহ তাআলা আয়াত নাজিল করেন-شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِىٓ أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْءَانُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنٰتٍ مِّنَ الْهُدٰى وَالْفُرْقَانِ ۚ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ۖ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ ۗ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلٰى مَا هَدٰىكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ‘রমজান মাস,
এ মাসেই নাজিল করা হয়েছে কুরআন। মানুষের জন্য হেদায়েত, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে রোজা পালন করে। তবে কেউ রোগাক্রান্ত হলে অথবা সফরে থাকলে এ সংখ্যা অন্য সময় পূরণ করবে।আল্লাহ চান তোমাদের জন্য যা সহজ তা, আর তিনি চান না তোমাদের জন্য যা কষ্টকর তা, যেন তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করো এবং আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো, তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার জন্য এবং যেন তোমরা শুকরিয়া আদায় করতে পার।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)
পবিত্র রমজানের রোজার ক্ষেত্রে পাঁচটি পালনীয় দিক রয়েছে। ১. চাঁদ দেখে রোজা রাখা, ২. সকাল হওয়ার আগে রোজার জন্য নিয়ত করা, ৩. পানাহার ও জৈবিক বিশেষ করে যৌন চাহিদা পূরণ করা থেকে বিরত থাকা, ৪. ইচ্ছাকৃত বমি করা থেকে নিবৃত্ত থাকা ও ৫. রোজার পবিত্রতা রক্ষা করা।
রোজা
রোজা উপমহাদেশে পরিচিত শব্দ। এর আরবি হলো সওম, যার অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় যাবতীয় পানাহার এবং স্ত্রী সঙ্গম থেকে বিরত থাকার নাম সওম। ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত পুরো দিন খাবার থেকে বিরত থাকবে হয়। পবিত্র কোরআনে সওমের বিধান এভাবে দেওয়া হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)।
রমজানে এক মাস রোজা পালন করতে হয় প্রত্যেক মুসলমানকে। কেউ সফর কিংবা অসুস্থতার কারণে রোজা রাখতে না পারলে পরে কাজা করতে হবে। হজরত সাহল বিন সাদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জান্নাতের একটি দরজা আছে, একে রাইয়ান বলা হয়। এই দরজা দিয়ে কেয়ামতের দিন একমাত্র রোজা পালনকারীরাই জান্নাতে প্রবেশ করবেন। তাদের ছাড়া অন্য কেউ এই পথে প্রবেশ করবে না। সেদিন এই বলে আহ্বান করা হবে- রোজা পালনকারীরা কোথায়? তারা যেন এই পথে প্রবেশ করে। এভাবে সব রোজা পালনকারী ভেতরে প্রবেশ করার পর দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। তারপর এ পথে আর কেউ প্রবেশ করেবে না।’ (বুখারি : ১৮৯৬; মুসলিম : ১১৫২)
৪) হজ্ব।
হজ্ব শব্দের আভিধানিক অর্থ: “ইচ্ছা” বা “সংকল্প” একটি যাত্রায় অংশ নেওয়া, নিয়ত করা, দর্শন করা, এরাদা করা, গমন করা, ইচ্ছা করা, প্রতিজ্ঞা করাসহ যে কোনো মহৎ কাজের ইচ্ছা করা।
শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ সম্পাদন করা আবশ্যিক।
আরবি জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধরিত সময়।
হজ পালনের জন্য বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা নগরী এবং সন্নিহিত মিনা, আরাফাত, মুযদালিফা প্রভৃতি স্থানে গমন এবং অবস্থান আবশ্যক।
হজ হ’ল মুসলিম জনগণের সংহতি, এবং আল্লাহর নিকটে তাদের আনুগত্যের প্রদর্শনী। যিনি হজ সম্পাদনের জন্য গমন করেন তাকে বলা হয় হাজী বা আলহাজ।
সূরা বাকারার ১২৫ নম্বর আয়াতে কাবাঘর নির্মাণ সম্পর্কিত বিষয় এভাবে ইরশাদ হয়েছে :
وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِلنَّاسِ وَأَمْنًا وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى
وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ
‘আর আমি যখন কাবাঘরকে মানুষের জন্য সম্মিলন ও নিরাপত্তার স্থান করলাম আর তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজের জায়গা বানাও।
আর আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম ঘরটিকে খুব পবিত্র রেখো তাওয়াফকারী ও অবস্থানকারী লোকদের জন্য এবং রুকু-সিজদাকারীদের জন্য।’
আবু হোরায়রা বর্ণিত এক হাদিসে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ করে এবং অশ্লীল ও গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকে, সে হজ থেকে এমতাবস্থায় ফিরে আসে যেন আজই মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়েছে। অর্থাৎ জন্মের পর শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, সেও তদ্রূপই হয়ে যায়।’
আরেকটি হাদিসে তিনি বলেছেন: ‘শয়তান আরাফার দিন হতে অধিক লজ্জিত ও অপদস্থ আর কোনো দিন হয় না, কেননা ওই দিন আল্লাহতায়ালা স্বীয় বান্দার প্রতি অগণিত রহমত বর্ষণ করেন ও অসংখ্য কবিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’
হজ
আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান প্রতিটি পুরুষ-নারীর ওপর হজ ফরজ। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহর তরফ থেকে সেসব মানুষের জন্য হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে।’ (সুরা আল ইমরান : ৯৭)
হজের অর্থ ইচ্ছা করা ও সফর বা ভ্রমণ করা। ইসলামী পরিভাষায় হজ হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে বিশেষ কিছু কাজ সম্পাদন করা।
হজের নির্দিষ্ট সময় হলো ‘আশহুরুল হুরুম’ বা হারাম মাসগুলো তথা শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ; বিশেষত ৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন। হজের নির্ধারিত স্থান হলো আরবের মক্কা নগরীর কাবাগৃহ, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা, মুজদালিফা ইত্যাদি। হজের বিশেষ আমল বা কর্মকাল হলো ইহরাম, তাওয়াফ ও সাঈ, উকুফে আরাফা, উকুফে মুজদালিফা, উকুফে মিনা, দম ও কোরবানি, হলক ও কসর। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত হজের পুরস্কার বেহেশত ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না।’ (বুখারি : ১৭৭৩)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি যথাযথভাবে হজ পালন করে, সে পূর্বেকার পাপ থেকে এরূপ নিষ্পাপ হয়ে যায়, যেরূপ সে
মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন নিষ্পাপ ছিল।’ (বুখারি : ১৫২১)
৫) যাকাত।
যাকাত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোকন। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হল সালাত ও যাকাত। কুরআন মজীদে বহু স্থানে সালাত-যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ ছওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ ؕ وَ مَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَیْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ۱۱۰
‘তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। -সূরা বাকারা : ১১০
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ۵۶
‘তোমরা সালাত আদায় কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।’-সূরা নূর : ৫৬
সূরা নিসার ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য ‘আজরুন আযীম’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ الْمُقِیْمِیْنَ الصَّلٰوةَ وَ الْمُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ وَ الْمُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ ؕ اُولٰٓىِٕكَ سَنُؤْتِیْهِمْ اَجْرًا عَظِیْمًا۠۱۶۲
‘এবং যারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরস্কার দিব।’
অন্য আয়াতে যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ সুফল বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন-
خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِّیْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَیْهِمْ ؕ اِنَّ صَلٰوتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ۱۰۳
‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দুআ করবেন। আপনার দুআ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’-সূরা তাওবা : ১০৩।
হাদীস শরীফে এসেছে- ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তার যাকাত দেয়নি কিয়ামতের দিন তা বিষধর স্বর্পরূপে উপস্থিত হবে এবং তা তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ঐ ধন, আমিই তোমরা পুঞ্জিভূত সম্পদ।’ -সহীহ বুখারী।
যাকাত ফরয হওয়ার শর্তসমূহ
১. নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ, বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা, কিংবা সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হওয়া। ২. মুসলমান হওয়া। কাফেরের উপর যাকাত ফরয নয়। ৩. বালেগ হওয়া। নাবালেগের উপর যাকাত ফরয নয়। ৪. জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন হওয়া। সর্বদা যে পাগল থাকে তার নেসাব পরিমাণ মাল থাকলেও তার উপর যাকাত ফরয নয়। ৫. স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া। দাস-দাসীর উপর যাকাত ফরয নয়।
৬. মালের উপর পূর্ণ মালিকানা থাকা। অসম্পূর্ণ মালিকানার উপর যাকাত ফরয হয় না। ৭. নেসাব পরিমাণ মাল নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত হওয়া। ৮. নেসাব পরিমাণ মালের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া।
যাকাত যাদের দেওয়া যাবে
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা তাওবা : ৬০]
জাকাত
ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হলো নামাজ ও জাকাত। পবিত্র কোরআনে যত জায়গায় নামাজের আদেশ দেওয়া হয়েছে, সেখানে পাশাপাশি শব্দে জাকাতের আদেশও দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা সালাত আদায় করো এবং জাকাত প্রদান করো। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য আগে পাঠাবে তা আল্লাহর কাছে পাবে।
নিশ্চয়ই তোমরা যা করো আল্লাহ তা দেখছেন।’ (সুরা বাকারা : ১১০)। জাকাত শব্দের অর্থ পরিশুদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি। জাকাতের মাধ্যমে মুসলমানদের সম্পদ পরিশুদ্ধ হয় এবং বরকত অবতীর্ণ হয়। জাকাত অস্বীকার করা কুফুরি। কারও কাছে সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা থাকলে এবং তা এক বছর পূর্ণ হলে জাকাত ফরজ হয়। জাকাত গরিবের হক। কোরআনে জাকাতের হকদার আট শ্রেণির কথা বলা হয়েছে। জাকাত অস্বীকার কুফুরি। জাকাত না দিলে কঠিন শাস্তি হবে পরকালে।
যাকাত বণ্টনের খাত সমূহ :
যাকাত বণ্টনের খাত আটটিঃ যা আল্লাহ তা‘আলা সূরা তওবার ৬০ নং আয়াতে বর্ণনা করেছেন। তা নিম্নরূপ : (১) ফকীর (২) মিসকীন (৩) যাকাত আদায়কারী ও হেফাযতকারী (৪) ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কোন অমুসলিমকে (৫) দাস মুক্তির জন্য (৬) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি (৭) আল্লাহর রাস্তায় (৮) মুসাফির। উল্লেখ্য যে,
আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ৮ টি খাতের মধ্যেই যাকাত বণ্টন সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এর বাইরে যাকাত প্রদান করা সিদ্ধ নয়। তবে যাকাতকে সমান ৮ ভাগে ভাগ করতে হবে না। বরং ৮টি খাতের মধ্যে যে খাতগুলো পাওয়া যাবে সেগুলোর মধ্যে প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে কম- বেশী করে যাকাত বণ্টন করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে কোন একটি খাতে সম্পূর্ণ যাকাত প্রদান করলেও তা আদায় হয়ে যাবে।
যাকাত আদায়ের সময়
যাকাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময়ের বাধ্যবাদকতা নেই। তবে রমাদান মাসই যাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। রমাদানে দান-সদাকাহ করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সাওয়াব লাভ হয়। তাই পবিত্র রমাদান মাসে মু’মিন বান্দারা একসঙ্গে গরীবের হক যাকাত ও ফিতরা আদায় করে থাকে।
পরিশেষে বলা যায়, আলোচ্য বিষয় গুলোর চর্চা ও এগুলোর ওপর আমল করায় ইসলামের মূল দিকনির্দেশনা। একজন মুসলমানের জীবনে এই বিষয়গুলোর প্রতিফলন ঘটলে তবেই তার জীবন পরিপূর্ণ আদর্শে সার্থকতা লাভ করবে ।
সূত্র।
ইন্টারনেট।