ফুটবলের জনক কে , ফুটবল খেলাটি এমন একটি খেলা যেটা কম সময় বেশি উত্তেজনার কারণে মানুষের এই খেলাটির প্রতি আগ্রহ বেশি। তাছাড়া প্রতি চার বছর পর পর বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট টি এই খেলাটির জনপ্রিয়তা আরও বেশি সৃষ্টি করেছে। তাই আমরা আপনাদের কে জানিয়ে দেবো ফুটবলের জনক কে।
ফুটবল এর জনক জ্যাক রেনল্ডস। যিনি মূলত আজাক্স এর ম্যানেজার ছিলেন ১৯১৫ এর সময় থেকে ১৯৪৭ অব্দি প্রথম টোটাল ফুটবল এর প্রচলন হয় এর হাত ধরে। পরবর্তীতে যুগের পুর যুগ এই খেলাটির মধ্যে নানান ধরনের পরিবর্তনের সৃষ্টি হয়েছে।
Football (বা ফুটবল) খেলার জনক হিসেবে যেকোনও একজনই নির্ধারিত করা যায় না। কারণ ফুটবল খেলার ধারণা সামাজিক উন্নয়নের সাথে সাথেই বিকাশ পাওয়া শুরু করে।
বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের মতে:
১. চীনের হান ডাইনাস্টির সময়ে (১০৬ – খ্রীঃপূ ২২৫) ক্লাবসমূহে ফুটবল খেলা হতো।
২. আধুনিক ফুটবলের উৎপত্তি ইংল্যান্ডে মধ্যযুগে, যখন ফুটবল খেলার ধারণা ‘Folk football’ ছড়িয়ে পড়ে।
৩. ১৮৬৩ সালে ইংল্যান্ডে Football Association (FA) গঠিত হয়, যা আধুনিক ফুটবল খেলার জন্ম দেয়।
সুতরাং ফুটবলের ধারণা কেউ কেউ একজনের উৎপত্তি বলে দাবি করা যায় না। এটা সামাজিক উন্নয়নের সাথে সাথেই গড়ে উঠেছে এবং বর্তমানের আকার ধারণ করেছে।
ফুটবল খেলা করে শুরু হয়?
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। গত শতকের তৃতীয় দশকেই জনপ্রিয় বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরটি প্রথমবারের মতো বসে ল্যাটিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়েতে ১৯৩০ সালে। প্রতি ৪ বছর অন্তর এই আসর নিয়মিত বসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কখনও আমেরিকায়, কখনও ইউরোপে, কখনও আফ্রিকায়, কখনও এশিয়ায়। শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর কারণে ১৯৪২ এবং ১৯৪৬ এই ২টি বিশ্বকাপের আসর বসেনি।
ইতিহাসঃ
ইউরোপিয়ান কাপের কোয়ার্টার ফাইনাল প্রথম লেগের খেলা চলছে। গোলকিপারের কাছ থেকে বল নিয়ে এক সেন্টার ব্যাক প্রবল বিক্রমে সামনে এগোচ্ছেন। মাঝমাঠ পেরোনোর সাথেসাথেই তার দলের ফরোয়ার্ড দৌড়ে এসে সেন্টার ব্যাকের কাছ থেকে বল নিয়ে নিজেদের অর্ধে ৪০ গজ পর্যন্ত পেছনে গিয়ে আবার উল্টো ঘুরে গোলের জন্য আক্রমণ শুরু করলেন।
সেন্টার ব্যাক তখন ঐ ফরোয়ার্ডের জায়গায় চলে এসেছেন আর ঐ ফরোয়ার্ড রক্ষণভাগে বল পাসে ব্যস্ত! ঐ সময়ে ডাগ আউটে এক সৌম্য দর্শন প্রৌঢ় ভদ্রলোক মুচকি হাসছেন। পুরো ঘটনাটা এতটা দৃষ্টিনন্দন ছিল যে, বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা দর্শকদের মতই অবাক আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে খেলা বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এখনি যেন ঐ ফরোয়ার্ডকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘‘ব্যাপারটা কি মশায়? এসব হচ্ছেটা কি?’’
যদি সত্যিই প্রশ্ন করতেন, ফরোয়ার্ডের উত্তর হত,
‘‘ We are playing simple football which is the most beautiful game. But playing simple football is the hardest thing.’’
চিনতে পারছেন চরিত্রগুলোকে? আচ্ছা, পরিচয় দিচ্ছি এক এক করে।
ঘটনাটা ১৯৭৩ সালের। আয়াক্স অ্যামস্টারডাম বনাম বায়ার্ন মিউনিখের খেলা। ফরোয়ার্ডটির নাম ইয়োহান ক্রুইফ। ডাগ আউটের মানুষটি হলেন রাইনাস মিশেল। আর পুরো দৃশ্যটা টোটাল ফুটবল নামক আজব সিস্টেমের একটা নমুনামাত্র।
১৯৬৫-তে হঠাৎ করেই শুরু হওয়া ডাচ বিপ্লব বদলে দিয়েছিল ফুটবলের সব ধ্যান-ধারণাকে। পাল্টে দিয়েছিল সুন্দর ফুটবলের সংজ্ঞা। আর সেই ডাচ বিপ্লবের সূতিকাগার ছিল হল্যান্ডের রাজধানী অ্যামস্টারডাম শহরের বিখ্যাত এই ক্লাব আয়াক্স এফসি বা যা পরিচিত আয়াক্স অ্যামস্টারডাম হিসেবে।
১৯৬৫ সালে আয়াক্সের দায়িত্ব নেন ক্লাবের এক পুরনো খেলোয়াড়। নাম মেরিনাস জ্যাকোবস হেনড্রিক মিশেল। পুরো ক্যারিয়ার (১৯৪৬-১৯৫৮) আয়াক্সেই খেলা এই স্ট্রাইকার হিসেবে ২৬৪ ম্যাচে করেছিলেন ১২২ গোল। দু’বার জিতেছেন ডাচ লিগ।
খেলোয়াড়ি জীবনের তুখোড় এই স্ট্রাইকার রাখতে শুরু করলেন কোচ হিসেবেও দারুণ প্রতিভার স্বাক্ষর। সেই সময় রেলিগেশনের আতঙ্কে ভুগছে দলটা। কিন্তু দায়িত্ব নিয়েই দলের খোলস পাল্টে ফেললেন মিশেল। ইয়োহান ক্রুইফ, নেসকেন্স, পিত কাইজার, হালশফ বা জনি রেপের মত আয়াক্স একাডেমীর উঠতি তারকাদের মূল দলে প্রবেশ করান। সাথে দলে রাখেন বেনি মুলার, হেঙ্ক গ্রুট এবং থিও ফন দ্যুভেনবোদের মত অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের। মাত্র ৩ জন খেলোয়াড় কিনেছিলেন – রুদ ক্রল, গ্যারি মুহরেন এবং ভাস্কোভিক।
নবীন-প্রবীণের এই রসায়ন ধীরে ধীরে ফল দেওয়া শুরু করে। মিশেল প্রথম মৌসুমেই ডাচ লিগ জিতিয়ে অবাক করে দেন। সাথে মৌসুমের শেষের দিকে উদ্ভাবন করে বসেন এক ফুটবল তত্ত্ব। অনেকটা সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের আমলের মাস্কেটিয়ার বাহিনীর দর্শন ‘‘One for all & all for one’’ এর আধুনিক রূপ ‘১১ জন মিলে খেলবো। সবার জন্য খেলবো’ – কে উপজীব্য করে ফুটবলে নিয়ে আসেন টোটাল ফুটবলের ধারণা।
১৯৬৫-৭১, ৬ বছরে টোটাল ফুটবল দিয়ে আমূল বদলে দেন আয়াক্সকে। শুধু কি আয়াক্স? তাঁর ফুটবল মস্তিস্কের ছোঁয়া টের পায় ফুটবল জগত। টোটাল ফুটবল এবং অফসাইড ট্র্যাপের দারুণ ব্যবহার তাঁকে চিনতে বাধ্য করে। আয়াক্সকে ৪ বার ডাচ লিগ, ৩ বার ডাচ কাপ আর ১৯৭১ সালে ইউরোপিয়ান কাপ শিরোপা জেতান।
সামরিক কায়দায় দলকে অনুশীলন করানো কঠোর ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই কোচ পরিচিত ছিলেন ”দ্যা জেনারেল” নামে। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, ‘পেশাদার ফুটবল যুদ্ধের মত। যে এর সাথে মানিয়ে নিতে পারবে না, সে হারিয়ে যাবে অচিরেই।’
১৯৮৮ সালে হল্যান্ডকে ইউরো জেতানো এই কোচ ১৯৯৯ সালে ফিফার শতবর্ষের সেরা কোচের পুরস্কার অর্জন করেন।
টোটাল ফুটবল তত্ত্ব অনুযায়ী গোলকিপার বাদে দলের যেকোন খেলোয়াড় প্রয়োজন পড়লে অন্য যে কোন খেলোয়াড়ের পজিশন বা ভূমিকায় খেলবে। এই সিস্টেমের উদ্ভাবক রাইনাস মিশেলস। ১৯৬৫-৭৩ সময়ে আয়াক্স এবং ‘৭৪ বিশ্বকাপে হল্যান্ড দল এই স্টাইলের বিকাশ ঘটায়।
একজন খেলোয়াড় যখন নিজের পজিশন ছেড়ে অন্য কোন দিকে মুভ করেন তখন দলের আরেকজন খেলোয়াড় সেই পজিশনে চলে আসেন। ফলে দলের মূল গঠন একই থাকে। যে কেউ প্রয়োজন অনুযায়ী ফরোয়ার্ড, মিডফিল্ডার বা ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতে পারবে। শুধুমাত্র গোলকিপার অপরিবর্তনীয় পজিশনে খেলবে।
এই সিস্টেমে সাফল্য নির্ভর করে দলের প্রত্যেক খেলোয়াড় কিভাবে একে অপরের সাথে মানিয়ে নিতে পারে এবং খুব তাড়াতাড়ি নিজেদের ভেতরে পজিশন পরিবর্তন করতে পারে তাঁর উপর। এই তত্ত্বে খেলোয়াড়দের ভিন্ন ভিন্ন পজিশনে খেলার ক্ষমতাকে আয়ত্ব করতে হয়, এই জন্য প্রত্যেককে বেশ ভাল পরিমাণে শারীরিক এবং মানসিক নৈপুণ্যধারী হতে হয়।
‘Is an art in itself to compose a starting team, finding the balance between creative players and those with destructive powers, and between defense, construction and attack – never forgetting the quality of the opposition and the specific pressures of each match’ – রাইনাস মিশেল
ডাচ লিজেন্ড ক্রুইফ ছিলেন এই সিস্টেমের পোস্টার বয়। যদিও তিনি সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলতেন, পুরো মাঠ চষে বেড়াতেন। সবসময় বিপক্ষ দলকে কিভাবে বিপদে ফেলা যাবে সেই সুযোগে থাকতেন। ক্রুয়েফের সতীর্থরা তাকে কেন্দ্র করে নিজেদের মানিয়ে নেন এবং বারবার পজিশন পরিবর্তন করলেও দলের ট্যাকটিকস অনুযায়ী খেলতে শুরু করেন।
৪-৩-৩ ফর্মেশনকে কিছুটা পরিবর্তন করে ৪-২-৪ ফর্মেশনে খেলতে শুরু করে আয়াক্স। ফরোয়ার্ডরা শুধু সামনে বলের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন না, বরং উইং ধরে খেলতেন। আক্রমণ শুরু হত গোলকিপার থেকে। খুব তাড়াতাড়ি এবং প্রচুর পাসিং ফুটবল কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা টোটাল ফুটবলে মিডফিল্ডার এবং ডিফেন্ডাররাও উপরে উঠে আসবেন প্রয়োজনমত।
বারবার জায়গা পরিবর্তনের কারণে এই দলের খেলোয়াড়দের ম্যান মার্ক করা শয়তানের পক্ষেও দুঃসাধ্য ছিল। সাথে বলের নিয়ন্ত্রণ হারালে হেভি-প্রেসিং ফুটবল এবং দারুণ সুগঠিত অফসাইড ট্র্যাপ বলের দখল ফিরে পেতে বাধ্য করত।
“We played a kind of football that was not normal at that time in Europe, we played our own style – something you did not see in other countries, and that drew attention in Europe.” – ক্রুয়েফ
তাদের কাছে জয়ের অর্থ ছিল সহজ খেলা। ৯০ মিনিট জুড়ে পজিশন পরিবর্তন এবং একই স্ট্যামিনা ধরে রেখে ম্যাচের গতি নির্ধারণ এবং ম্যাচকে নিজেদের ইচ্ছেমত পরিচালনা করার ক্ষমতা কতো দারুণভাবে উপস্থাপন করা যায় ডাচরা দেখিয়েছিল।
মাঝমাঠে অনেক জায়গা ফাঁকা রেখে আয়াক্স খেলত এবং যখন আক্রমণে পুরো দল একসাথে যেত। এ যেন ডাচ অর্কেস্ট্রা। সাধারণত একসাথে ৭ জন আক্রমণ করতেন। আবার ডিফেন্ডাররা প্রস্তুত থাকতো যে কোন সময় ৩ জনের বিপক্ষে ৩ জন বা ২ জনের বিপক্ষে ৩ জনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য।
এই সিস্টেম কাজ করেছিল দলগত ভাবে, পুরো খেলাটাই ছিল দলগত। সবাই মিলে ফাঁকা স্থান ব্যবহার করে একসাথে আক্রমণ এবং রক্ষণকাজ সামলাতেন। একা রাইনাস, কোভাক বা ক্রুয়েফ পুরো কৃতিত্বের দাবিদার ছিলেন না।
১৯৬৫-৭০ সময়ে ৫ বছরে ৪ বার ডাচ লিগ এবং ২ বার ডাচ কাপ জেতে আয়াক্স। কিন্তু ১৯৬৬-তে লিভারপুলকে ৫-১ এ হারানো ছাড়া ইউরোপের আসরে তেমন সুবিধা করতে পারছিল না মিশেলের ছাত্ররা।১৯৬৮-৬৯ মৌসুমে সবাইকে চমকে দিয়ে টোটাল ফুটবলের প্রতিফলন দেখিয়ে প্রথমবারের মত ফাইনালে ওঠে আয়াক্স। কিন্তু মাদ্রিদের বার্নাব্যু স্টেডিয়ামে এসি মিলানের শক্তিশালী ডিফেন্স এবং প্রাতি পিয়েরিনোর হ্যাটট্রিকে ৪-১ গোলে উড়ে যায় তরুণ ডাচ দলটি।
১৯৭১-৭৩ সময়ে ২ বার করে ঘরোয়া লিগ এবং কাপ জেতে আয়াক্স। কিন্তু টোটাল ফুটবলের আসল নমুনা দেখায় ইউরোপিয়ান কাপে। ১৯৭০-৭১ মৌসুমে ইউরোপিয়ান কাপে চ্যাম্পিয়ন ফেয়েন্যুর্দ বাদ পড়ে প্রথম রাউন্ডেই। কিন্তু ডাচ ফুটবলের বিজয় গাঁথা ধরে রাখে আয়াক্স। বাসেল, সেল্টিক, অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদকে হারিয়ে ফাইনালে মুখোমুখি হয় ঐ আসরের চমক দেখানো গ্রিক ক্লাব প্যানাথিয়াকোসের।
ওয়েম্বলির সেই ফাইনালে ফেরেঙ্ক পুসকাসের কোচিং করানো গ্রিক দলটিকে আরি হান এবং ভ্যান ডিকের গোলে উড়িয়ে দিয়ে প্রথমবারের মত শিরোপার স্বাদ নেয় অ্যামস্টারডাম শহরের দলটি। ঐদিন পুরো স্টেডিয়ামের দর্শকরা আয়াক্সের টোটাল ফুটবলের আগমনী বার্তা শোনে।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেই দল ছাড়েন মিশেল। বলে গিয়েছিলেন, “যা কিছু সম্ভব, সবই পেয়ে গিয়েছি। এর থেকে ভালো কিছু করাও অসম্ভব।”
দলের দায়িত্ব নেন রোমানিয়ান স্তেফান কোভাক। ভুল প্রমাণ করেন মিশেলের উক্তিকে। রাইনাস মিশেলের দলকে ভয়াবহ আক্রমনাত্নক খেলানো শুরু করেন তিনি। খেলোয়াড়দের নিজেদের মত করে খেলার স্বাধীনতা দেন। টোটাল ফুটবলের বিধ্বংসী রূপ দেখে বিশ্ব।
১৯৭১-৭২ এবং ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে আয়াক্স একবারও নিজেদের মাঠে হারেনি। ১৯৭১-৭২ এর পুরো মৌসুমে হেরেছিল মাত্র ১ বার। দারুণ প্রভাব রেখে জিতে নেয় ডাচ লিগ, ডাচ কাপ, ইউরোপিয়ান কাপ এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ। ইউরোপের আসরে অলিম্পিক মার্শেই, আর্সেনাল, বেনফিকার মত ইউরোপিয়ান পরাশক্তিদের পরাভূত করে ফাইনালে আয়াক্সের সামনে পড়ে ইন্টার মিলান। ইন্টারের বিখ্যাত রক্ষণদুর্গও থামাতে পারেনি টোটাল ফুটবলের জয়গান। ক্রুয়েফের জোড়া গোলে ইন্টারের কাত্তেনাচ্চিও সিস্টেমের রক্ষণকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ২-০ গোলে জেতে টোটাল ফুটবলের ডাচরা।
১৯৭২ এর সেই ফাইনাল পরিষ্কার ধারণা ছড়ায়, আয়াক্স এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ফুটবল কিভাবে খেলতে হয়। ফাইনালের পরদিন সব পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘টোটাল ফুটবলের কাছে কাত্তেনাচ্চিওর মৃত্যু বা রক্ষণশীল ফুটবলের খুন।’
১৯৭৩ আসরে ইউরোপ সেরার আসরে আয়াক্স একে একে সিএসকেএ সোফিয়া, বায়ার্ন মিউনিখ, রিয়াল মাদ্রিদের মত সেরাদের সেরা দলগুলোকে টোটাল ফুটবলের দমকা হাওয়ায় বিধ্বস্ত করতে থাকে। কোয়ার্টারে ৪-০ গোলে হারায় ব্যাভারিয়ানদের।
তবে টোটাল ফুটবলের আধিপত্যের মূল প্রতিচ্ছবি দেখা যায় সেমিতে রিয়ালের সাথে। ৩-১ অ্যাগ্রিগেটে জিতলেও আয়াক্সের টোটাল ফুটবল চোখ ধাঁধিয়ে দেয় সবার। গেরি মুহরেন খেলা চলাকালীন অবস্থায় রুদ ক্রলকে পাস দেওয়ার আগে মাঠের মধ্যে বল নিয়ে জাগলিং করা শুরু করেন। বার্নাব্যুর দর্শকরা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। প্রবল পরাক্রমশালী মাদ্রিদের নিজেদের মাঠে এরকম প্রভাব বিস্তার এর আগে কেউ করেনি। বলা হয়, ঠিক সেই মুহূর্তেই মাদ্রিদের কাছ থেকে ইউরোপের রাজমুকুট ছিনিয়ে নেয় ডাচরা।
ফাইনালে আরেক ইতালিয়ান ক্লাব জুভেন্টাসের সাথে দেখা হয় তাদের। পাসিং ফুটবলের পসরা সাজিয়ে বেলগ্রেডের ফাইনালে ম্যাচের শুরুতেই জনি রেপের গোলে এগিয়ে যাওয়া আয়াক্স পুরো ৯০ মিনিট একপেশে টোটাল ফুটবল খেলে টানা তৃতীয়বারের মত শিরোপা জেতে।
পতন
দলের হৃদপিণ্ড খ্যাত ক্রুয়েফ ক্লাব ছাড়েন সেই মৌসুমে। কারো মতে, অধিনায়কত্ব না পাওয়ার কারণে, আবার কারো মতে, ইনজুরি আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও ক্লাব জোর করে খেলতে বাধ্য করেছিলো তাকে। ক্রুয়েফ সেই সময়ের বিশ্বরেকর্ড ফি ৬ মিলিয়ন গিল্ডার্সের বিনিময়ে তাঁর সাবেক কোচ রাইনাস মিশেলের বার্সেলোনায় যোগ দেন। আয়াক্সের কোচ নিযুক্ত হন জর্জ নোবেল।
যদিও নোবেল আয়াক্সের ক্লাসিক ফুটবল মডেল থেকে খুব একটা সরে আসেননি, কিন্তু ক্রুয়েফের শূন্যস্থান পূরণ করা অসম্ভব ছিল। ডাচ লিগে আয়াক্সকে টপকে ফেয়েন্যুর্দ শিরোপা দখল করে আর ইউরোপের আসরে প্রথম রাউন্ডেই ছিটকে পড়ে তারা। এভাবেই পতন ঘটে ডাচ সাম্রাজ্যের। কিন্তু ১৯৭৪ সাল থেকেই টোটাল ফুটবলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। এরপর আয়াক্সের আধিপত্য না থাকলেও ফুটবল কিভাবে দর্শনীয় করে খেলতে হয় সেই পথ দেখিয়ে গেছে দলটি।
টোটাল ফুটবল এমন এক ধারণা যা তার আগের যুগের ফুটবল এবং পরবর্তী সময়ের ফুটবলকে আলাদা করে দিয়েছে। গত ৪০ বছর ধরে সৌন্দর্যের সুবাস ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে এই ধারণা। হয়ত কিছুটা ভিন্ন হয়ে, কিছুটা নতুন আঙ্গিকে। কিন্তু টোটাল ফুটবলের সৌন্দর্যের ধারেকাছেও আসতে পারেনি নতুন কোন সিস্টেম। ইতিহাস সবাই বদলাতে পারে না, ক্রুয়েফ-মিশেল-নেসকেন্স-কোভাক-কাইজাররা পেরেছিলেন। হারিয়ে যাওয়ার মত করে নয়, সারাজীবন ফ্রেমে বাধিয়ে রাখার মত করে।
(সমস্ত ছবির সুত্রঃ- ইন্টারনেট ও গেটি ইমেজেস)