সালাত শব্দের অর্থ কি , সালাতের অর্থ সংযোগ বা যোগাযোগ – এবং আরও নির্দিষ্টভাবে, আল্লাহর সাথে মানুষের সংযোগ বা যোগাযোগ। আল্লাহ মানুষের সাথে যোগাযোগ করেন রাসুলের মাধ্যমে কিতাব/গ্রন্থ পাঠিয়ে এবং ওহী করে , আর মানুষ আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করে দোয়া/প্রার্থনার মাধ্যমে।]
ভুলভাবে দাবি করা হয় যে কুরআনে উল্লেখিত صلاۃ (সালাত) হল ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি প্রার্থনা বা “নামাজ” , যা ইসলাম-পূর্ব মুশরিক পৌত্তলিক আচার-অনুষ্ঠানের নামান্তর। যথা :- পাথরের ঘরের দিকে মুখ করে দেবতাদের সামনে দাঁড়ানো, তাদের কাছে মাথা নত করা এবং মাটির দেবতাকে সেজদা করা।
এই নামাজ শুরু করেছিল আব্বাসীয় আমলে পার্শি ইমামরা রাজ মাতার পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সাহায্যে জরথুস্ট্রিয়ান ধর্মের অগ্নি পুজার অনুকরনে। একমাত্র পার্থক্য হল আরব পৌত্তলিকরা চাঁদের দেবতার দিকে মুখ করে তাদের ৫ ওয়াক্ত প্রার্থনা করত , যেখানে জরথুস্ট্রিয়ানরা তাদের সূর্য দেবতার দিকে মুখ করে ৫ ওয়াক্ত প্রার্থনা করত যাকে তারা বলে থাকে ‘গাহ’।যাইহোক, আচার এবং সময় উভয় ক্ষেত্রেই গাহ ও নামাজ একই।
কোরান হল সর্বোচ্চ আল্লাহর বাণী এবং মানবজাতির জন্য সরল আরবি ভাষায় অবতীর্ণ পথনির্দেশ /হেদায়েত। বোঝার অভাবের ফলে, অনেক লোক কোরান অধ্যয়ন করে না বা এর আয়াত নিয়ে চিন্তাও করে না।]
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৪৩)
সালাত শব্দের অর্থ কি
সালাতের অর্থ সংযোগ বা যোগাযোগ – এবং আরও নির্দিষ্টভাবে, আল্লাহর সাথে মানুষের সংযোগ বা যোগাযোগ।
আরবীতে দরজার “কবজা” কে صل (সাল) বলা হয় যা দরজা এবং দরজার ফ্রেমের মধ্যে একটি সংযোগ/লিঙ্ক তৈরি করে। জনপ্রিয় আরবি শব্দ “اتصالات” (ইত্তি সালাত) ও একই মূল থেকে উদ্ভূত এবং একটি সম্পূর্ণ মন্ত্রণালয় বা যোগাযোগের একটি বিভাগকে সৌদি আরব সহ সমস্ত আরবি দেশে “الاتصالات” (আল ইত্তি সালাত) বলা হয় এবং এই মন্ত্রণালয়ের কার্যকরী নাম বা প্রতিষ্ঠান হল “مواصلات” (মাওয়া সালাত) , যেটিও صلاۃ (সালাত) এর একই মূল থেকে উদ্ভূত।
উল্লিখিত প্রতিষ্ঠান “الاتصالات” (আল ইত্তি সালাত) এবং এর সাংবিধানিক কার্যাবলী “مواصلات” (মাওয়া সালাত) বা “اتصال” (ইত্তি সাল) এর সাথে কোন আচার অনুষ্ঠান “ইবাদাত” বা “নামাজ” এর কোন সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে এই বিভাগের ভূমিকা হল “সমস্ত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন ও প্রশাসন” অর্থাৎ রাস্তা তৈরি করা, পরিবহন সংযোগ, সংযোগস্থল এবং সংযোগ স্থাপন করা”। যোগাযোগ, সংযোগ, সংযোগ সম্পর্ক, টেলিযোগাযোগ, ট্রাফিক, সার্কিট এবং কানেক্টিভিটি একই মূল থেকে আরবি শব্দ “اتصالية” (ইত্তি সালিয়া) এর অধীনে আসে।
সালাত শব্দের অর্থ কি
তাওয়াসিল (تَوَاصُل) একই মূল থেকে আরেকটি জনপ্রিয় শব্দ যা ব্যবহৃত হয়: যোগাযোগ; সংযোগ; আন্তঃযোগাযোগ; পারস্পরিক সম্পর্ক ; Geting in touch (কারো সাথে) ইত্যাদি প্রকাশে। صلاۃ (সালাত) এর আদি মূলের উদ্ভবের ব্যবহার আধুনিক আরবীতেও এর প্রাথমিক অর্থ পরিবর্তন করেনি। বর্তমানে কম্পিউটার বা জিপিআরএস সংযোগকে “توصيل”
(তাও সীল) বলা হয়। ইত্তি সাল “اتصال” শব্দটি এখনও আরবীতে ফোন, কম্পিউটার বা ট্যাবলেট থেকে “কল” প্রতিষ্ঠা করতে ব্যবহৃত হয়। আরব সংস্থা এখনও আমলাতন্ত্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বিভাগের সাথে যোগাযোগ রাখতে ইত্তি সাল “اتصال” শব্দটি ব্যবহার করে।
লগইন এবং লগঅন হল ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন, সার্ভারের সাথে সংযোগ স্থাপন, সংযোগ স্থাপন, যোগদান বা ইমেল এবং সামাজিক নেটওয়ার্ক যেমন ফেসবুক বা লিঙ্কডইন ইত্যাদিতে যাওয়ার জন্য ইত্তি সাল “اتصال” আধুনিক পরিভাষা। । একটি টেলিফোন নম্বর ডায়াল করাকে এখনও ইত্তি সাল “اتصال” বলা হয়। সাধারণভাবে সব ধরনের সংযোগকে আরবীতে ইত্তি সাল “اتصال” বলা হয়।
আল্লাহ বলেন, ‘আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। কেননা আপনার ক্ষমা প্রার্থনা তাদের জন্য প্রশান্তি লাভের উপায়।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১০৩)
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে صلاۃ (সালাত) এর ডেরিভেটিভগুলি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ফ্লাইট, ট্রেন, বাস সার্ভিস বা পরিবহন, আইনি, অর্থ, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, শিক্ষা, পর্যটন, ব্যবসা, অবসর এবং গৃহস্থালির সংযোগে صلاۃ (সালাত) এর ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। “ফোকাল পয়েন্ট” কে” نقطة اتّصال” (নুকতা ইত্তি সাল) বলা হয়।
সামরিক পরিভাষায় “সংযুক্ত পরিখা” কে “خنادق اتصال” (খনাদক ইত্তিসাল) বলা হয়। সামরিক এবং আর্থিক উভয় ক্ষেত্রেই খাতকে “خط اتصال” (খাত ইত্তিসাল) বলা হয়। এছাড়াও পরিভাষা “ধারাবাহিকতার সমাধান” عدم اتصال এবং “যোগাযোগ গোষ্ঠী” فريق اتصال অর্থনীতিতে ও রাজনীতিতে ব্যবহৃত হয়। এগুলি সকলেই صلاۃ (সালাত) এর একই মূল শব্দ থেকে উদ্ভূত যা এই নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রাইম রুট صل (সাল) বা মূল শব্দ “صلاۃ” আরবি বা এর সমগোত্রিয় হিব্রু বা আল্লাহর পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থের সেমেটিক ভাষাগুলিতে প্রার্থনা বা উপাসনার জন্য কখনও ব্যবহৃত হয়নি। যাইহোক, “صلاۃ” (সালাত) আল্লাহর প্রতিটি প্রত্যাদেশে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল এবং এটি কোরানেও নাযিল হয়েছে। আল্লাহ প্রত্যেকের জন্য তাঁর প্রত্যাদেশের অনুশীলন (আল্লাহর সুন্নাহ) অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করেছেন, যা শুরু থেকে কখনও পরিবর্তন হয়নি।
{سُنَّةَ اللَّهِ الَّتِي قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلُ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّهِ تَبْدِيلًا (৪৮:২৩)।
আল্লাহর প্রত্যাদেশের অনুশীলন যা আগে থেকেই বজায় রাখা হয়েছে এবং তাঁর চিরস্থায়ী প্রত্যাদেশের অনুশীলনে কোনও পরিবর্তন করা হয়নি”}
যদি আমরা কোরানে বিশ্বাস করি যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে আল্লাহর ঐতিহ্য বা আল্লাহর প্রত্যাদেশের অনুশীলন বা আল্লাহর আইন, যা তিনি পূর্বে তৈরি করেছেন, কখনও পরিবর্তন হয় না। তদুপরি, কোরান আরও বলে যে এটি একই “صلاۃ” (সালাত) যা ইব্রাহিম এবং পূর্ববর্তী সমস্ত নবীদের দেওয়া হয়েছিল।
পূর্ববর্তী ঐশী কিতাবের লোকদের মধ্যে কোন নামাজ কখনও দেখা যায় না , তবে এটি প্রাক-ইসলাম মুশরিক পৌত্তলিক সংস্কৃতিতে পাওয়া যায় এবং বর্তমানে এটি জরথুস্ট্রিয়ান ধর্মে অনুশীলন করা হয়। (সুত্র- আনোয়ার আল-জুন্দি লিখিত ‘দ্য মিজান অফ ইসলাম’, ৮১৯ খৃ: হিশাম ইবনে আল কালবি লিখিত ‘দ্য বুক অফ আইডলস’ (কিতাব আল-আসনাম)।)
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অস্বীকার করেছিল এবং পাপাচারী অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৮৪)
{আমি হুকুম করলাম, তোমরা সবাই নীচে নেমে যাও। অতঃপর যদি তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে কোন হেদায়েত পৌঁছে, তবে যে ব্যক্তি আমার সে হেদায়েত অনুসারে চলবে, তার উপর না কোন ভয় আসবে, না তারা চিন্তাগ্রস্ত ও সন্তপ্ত হবে।২:৩৮}
সালাত শব্দের অর্থ কি
আল্লাহ মানুষের সাথে যোগাযোগ করেন (সালাত) হেদায়েত করা তথা সঠিক পথ প্রদর্শনর জন্য। এই হেদায়েতটা কী? এই হেদায়েত হল আল্লাহর আদেশ , নিষেধ , উপদেশ , সাবধান বাণী ও সুসংবাদ। এগুলো আমরা মুসলিমরা কোথায় পাব? কোরানে। আল্লাহ তো সালাত অর্থাৎ যোগাযোগ করলেন , হেদায়েত গ্রন্থ কোরান পাঠালেন কিন্তু আমরা তা না বুঝে পড়লাম বা পড়লাম না , তাহলে কি আমরা আল্লাহর হেদায়েত অনুসারে চলতে পারব বা আল্লাহর মানুষের সাথে যোগাযোগ সম্পন্ন হবে? না। একের সাথে অন্যের যোগাযোগ তখনই সম্ভব , যখন তারা একে অপরের কথা বুঝতে পারে। অন্যথায়-
{যাদেরকে তওরাত দেয়া হয়েছিল, অতঃপর তারা তার অনুসরণ করেনি, তাদের দৃষ্টান্ত সেই গাধা, যে পুস্তক বহন করে। যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে, তাদের দৃষ্টান্ত কত নিকৃষ্ট। আল্লাহ অন্ধকারাচ্ছন্ন সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।৬২:৫}
একটি সালাত অধিবেশন হল একটি গাইডের (কোরানের) মাধ্যমে আল্লাহর এই বার্তাগুলি স্মরণ করিয়ে দেওয়া/স্মরণ করা (জিকর)। এই নির্দেশিকা হতে পারে একজন বার্তাবাহক(রাসুল) , একটি স্মরনিকা (কোরান), একজন প্রজ্ঞার মানুষ (সূরা ৩১এর লোকমান) অথবা কেবল একজন ব্যক্তির নিজের অন্তর্নিহিত বিবেক।
কোরান নাযিলের সময় এই পথপ্রদর্শক ছিলেন স্বয়ং রসূল। লোকেরা নিয়মিত সালাত সেশনে বার্তা/বার্তাবাহকের সাথে সরাসরি যোগাযোগের (সালাত) মাধ্যমে বার্তাগুলি গ্রহণ করত, সম্ভবত দিনে দুবার। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রোতাদের এই চলমান যোগাযোগ (সালাত) বাস্তবে প্রয়োগ করতে বলা হয়েছিল। এইভাবে অবিরাম কোরানের আহ্বান “আকীমু আলসালাতা” হল ছালাত/যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেকে ও সমাজকে পরিশুদ্ধ (যাকাত) করা।
সালাত “আনুষ্ঠানিক পার্শি নামাজ সম্পাদন” সম্পর্কে নয় বরং ক্রমাগত ঐশী বাণীর প্রতি বিনয়াবনত হয়ে (রুকু) মনোযোগ দেয়া এবং বাস্তব জীবনে আল্লাহর বাণী মেনে নিয়ে (সুজুদ) সেগুলি বাস্তবায়ন করার আহ্বান। আর সালাতের কিয়াম হল আল্লাহর বানী তথা আদেশ নিষেধের উপরে দৃঢ়ভাবে দাড়িয়ে বা কায়েম থাকা।
স্পষ্টতই, নবীর সময়ে সালাতের অধিবেশনগুলি ছিল নতুনভাবে প্রকাশিত বাণীগুলির উপর চিন্তা করার এবং সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে তথ্য প্রেরণের বিষয়ে। তাদের সালাত এইভাবে আল্লাহর বাণী বুঝে পড়া এবং চিন্তাভাবনা এবং যুক্তির সাথে সম্পন্ন হত , যার সাথে সম্পর্ক নেই আজকের বুদ্ধিহীন আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্ব নামাজের , যা ঐতিহ্যগতভাবে পুনরাবৃত্তিমূলক যান্ত্রিক অঙ্গভঙ্গী এবং রোবোটিক মন্ত্রজপ নিয়ে গঠিত।
সালাত তথা যোগাযোগ ব্যপক অর্থে সব ভাষাতেই ব্যবহার হয়। এটি ব্যবহারিক ও আত্মিক (মনের যোগ), দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়। বাক্যের প্রসঙ্গ /context অনুযায়ী যেমন যোগাযোগের মানে / মাধ্যম পরিবর্তন হয় , তেমনি কোরানের আয়াতের প্রসঙ্গ অনুযায়ী সালাতের মানে ও পরিবর্তন হয়।
এখন, বহু-অর্থবোধক শব্দ সালাত, যা মূলত সংযোগ বা যোগাযোগকে বোঝায়, সাথে অন্যান্য সম্পর্কিত অর্থ যেমন যোগাযোগ, (কারো)দিকে ফিরে আসা, কাছাকাছি হওয়া, বন্ধন, ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করা, সমর্থন করা, সংযুক্ত থাকা ইত্যাদি হয় প্রসঙ্গের উপর নির্ভর করে। সালাত মূলটি কোরানে ৯৯ বার চারটি আকারে এসেছে: বিশেষ্য হিসেবে ৮৩ বার সালাত (সংযোগ/যোগাযোগ), ১২ বার ক্রিয়াপদ হিসাবে ‘সাল্লা’ (সমর্থন বা ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করুন), ৩ বার সক্রিয় অংশীদার মুসাল্লিন হিসাবে (যারা সংযোগ/যোগাযোগ/অনুসরণ করে , এবং একবার বিশেষ্য হিসাবে মুসাল্লান (যোগাযোগের স্থান)।
প্রথমে সেই সমস্ত আয়াত নিয়ে ভাবুন , যেখানে সালাত শব্দটি প্রচলিতভাবে কিন্তু ভুলভাবে ধর্মীয় প্রার্থনা বা নামাজ হিসাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তাহলে দেখবেন যে , এই আয়াতগুলি আরও ভাল অর্থপূর্ণ হয় যদি নামাজের পরিবর্তে সালাত শব্দটিকে এর আসল কোরানিক অর্থ, যেমন সংযোগ বা যোগাযোগ – এবং আরও নির্দিষ্টভাবে, আল্লাহ ও আল্লাহর বার্তার সাথে সংযোগ বা যোগাযোগের মাধ্যমে বুঝি। আল্লাহ চাহেতো সকলের বুঝে আসবে। যদি কোন আয়াতে সালাতের মানে যোগাযোগ করলে বোধগম্য না হয় , তাহলে মন্তব্যে জানান। আমার এক বোন নিম্নের আয়াত দিয়ে জানতে চেয়েছেন , মধ্যবর্তী সালাত কোনটি?
২:২৩৮ حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلَاةِ الْوُسْطَىٰ وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ
সমস্ত সালাতের (সালাওয়াত الصَّلَوَاتِ) প্রতি মনযোগী হও ( حْفَظُوا ) , বিশেষ করে উত্তম (আলউসতা الْوُسْطَىٰ) সালাতের ব্যাপারে। আর আল্লাহর জন্য একান্ত আদবের সাথে দাঁড়াও(وَقُومُوا)।
সালাতের সঠিক মানে সকলের কাছে পরিস্কার বোধগম্য হওয়ার জন্য এই আয়াতটি একটি গুরুত্বপূর্ন আয়াত। এই আয়াতের ব্রাকেটবন্দী ৪ টি আরবি শব্দ নিয়ে আলোচনা করব যেগুলোর মানে পার্শি ইমামরা পরিবর্তন করেছে। কোরানের অন্যান্য আয়াতে ও এই একই শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে এবং ঐ সকল আয়াতের মাধ্যমে এই আরবি শব্দগুলির সঠিক মানে জানার চেষ্টা করব।
১) সালাওয়াত الصَّلَوَاتِ- পার্শি ইমামরা এই শব্দের মানে করেছে নামাজগুলো। সালাত একবচন -সালাওয়াত বহুবচন।
সালাওয়াতের মানে যে নামাজগুলো হতে পারে না বা সম্ভব নয় তা আমরা জানতে পারি নিম্নের আয়াত থেকে:
{أُولَـٰئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِّن رَّبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ ۖ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ
তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর সালাওয়াত ( صَلَوَاتٌ ) ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত।২:১৫৭}
এই আয়াতের সালাওয়াতের মানে যদি নামাজগুলি করেন তাহলে কি কোন মানে হয়? আল্লাহ সেই সমস্ত লোকের প্রতি নামাজগুলি পড়েন? কোন পাগলেও এটা বিশ্বাস করবে? তাহলে সালাওয়াতের মানেই বা কী , যেটা আবার রহমত ও এবং যা পেলে মানুষ হেদায়েত প্রাপ্ত হয়, যেমনটি এই আয়াতে বলা হয়েছে? এটা জানতে ১৫১ আয়াত থেকে পড়ে আসেন তাহলে জানবেন এগুলো হল আল্লাহর বাণী ও বিভিন্ন উপদেশ।
আল্লাহ মানুষের সাথে খোশ গল্প করার জন্য যোগাযোগ করেন না , তিনি যোগাযোগ করেন পথ দেখানোর জন্য , হেদায়েতের জন্য। বাণী , কথা এগুলো যোগাযোগের একটি রূপ। আল্লাহ এই যে বাণী ও উপদেশের মাধ্যমে মানুষের সাথে যোগাযোগ করলেন , এটাই সালাওয়াত। এই সালাওয়াত (বাণী) ,যারা মেনে চলল , তারাই হেদায়েতপ্রাপ্ত।
২) আলউসতা الْوُسْطَىٰ এর মানে ইমামরা করেছে মধ্যবর্তী। কোরানে আর যত জায়গায় আলউসতা শব্দটি আছে সে সকল জায়গায় মধ্যবর্তী অনুবাদ করলে আয়াতের কোন মানে হয় না। উসতা মানে ভাল, উত্তম ইত্যাদি। চলুন দেখা যাক:
{قَالَ أَوْسَطُهُمْ أَلَمْ أَقُل لَّكُمْ لَوْلَا تُسَبِّحُونَ
তাদের উত্তম ব্যক্তি (أَوْسَطُهُمْ ) বললঃ আমি কি তোমাদেরকে বলিনি? এখনও তোমরা আল্লাহ তা’আলার পবিত্রতা বর্ণনা করছো না কেন? ৬৮:২৮}
উপরের আয়াতে দুই জন মানুষের মধ্য থেকে এক জনের কথা বলা হয়েছে। অনেক মানুষের মধ্য থেকে তো আর মধ্যম বা মধ্যবর্তী বাছাই করা যায় না। চলুন আরো আয়াত দেখি:
{ … অতএব, এর কাফফরা এই যে, দশজন দরিদ্রকে খাদ্য প্রদান করবে; ভাল (أَوْسَطِ) খাদ্য যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে দিয়ে থাক।…৫:৮৯}
উপরের আয়াতে দেখুন – আউসাত মানে ভাল কারন আমরা যথাসাধ্য নিজের পরিবার পরিজনকে ভাল/ উত্তম খাদ্যই দিয়ে থাকি , মধ্যম বা মধ্যবর্তী খাদ্য নয়। দান খয়রাত করা নিয়ে একটি সাধারন নির্দেশ আছে কোরানে। ভাবুন-
{হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় কর এবং তা থেকে নিকৃষ্ট জিনিস ব্যয় করতে মনস্থ করো না। কেননা, তা তোমরা কখনও গ্রহণ করবে না; তবে যদি তোমরা চোখ বন্ধ করে নিয়ে নাও। জেনে রেখো, আল্লাহ অভাব মুক্ত, প্রশংসিত।২:২৬৭}
৩)কুমু وَقُومُوا মানে দাড়ানো বা কায়েম থাকা। আল্লাহর আদেশ নিষেধ বা হেদায়েতের উপরে কায়েম থাকা যায় আক্ষরিক অর্থে দাড়ানো যায় না। এখানে দাড়ানো রুপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
৪) حْفَظُوا মানে রক্ষা করা /হেফাজত করা।
৫:৮৯ আয়াতে বলা হয়েছে – وَاحْفَظُوا أَيْمَانَكُمْ তোমাদের শপথ সমূহ রক্ষা কর। শপথ রক্ষা করার মানে শপথ না ভাঙ্গা। তদ্রুপ আল্লাহর সালাওয়াত রক্ষা করার মানে আল্লাহর বাণী ভুলে না যাওয়া বা স্মরন করা বা মনযোগ দেয়া , চোর ডাকাতের হাত থেকে রক্ষা করা নয়।
২:২৩৮ আয়াতের আগে পিছের আয়াতগুলো পড়ুন , তাহলে দেখবেন- ২২১ আয়াত থেকে ২৩৭ আয়াতে নারী , বিয়ে ও তালাক সংক্রান্ত বিভিন্ন আদেশ , নিষেধ ও উপদেশ দেয়া আছে। ২৩৮ আয়াতে সালাওয়াতের কথা বলে আবার ও ২৪০-২৪২ আয়াতে তালাকের কথা বলে শেষ হয়েছে এভাবে-“এভাবেই আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য স্বীয় নির্দেশ বর্ণনা করেন যাতে তোমরা তা বুঝতে পার।
” ফলে আমরা বুঝতে পারি ২:২৩৮ সালাওয়াত শব্দটি দিয়ে কোন পার্শি নামাজ নয় বরং নারী , বিয়ে ,তালাক সংক্রান্ত নির্দেশ দিয়ে মানুষের সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং নির্দেশগুলো তে মনযোগী হতে বলেছেন বিশেষ করে উত্তমগুলো। নিজের পরিবারের জন্য উত্তম খাদ্য যেভাবে নিজেরাই ঠিক করি , তেমনি যার জন্য যেমন প্রযোজ্য সে তেমনি ভাবে নারী , বিয়ে , তালাক সংক্রান্ত নির্দেশের কোনটা উত্তম তা ঠিক করবে।
মানুষ আল্লাহর সাথে যোগাযোগ (সালাত) করে দোয়ার মাধ্যমে।
দোয়া /دعاء হল একটি আরবি শব্দ যার আক্ষরিক অর্থ হল কাউকে ডাকা। এই অর্থে মুসলিমদের জীবনে দোআ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ দোয়া হল সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে কথোপকথনের মতো , যেখানে আমরা আমাদের প্রয়োজনগুলি তাঁর সামনে রাখি এবং আমাদের সমস্যার সমাধানে তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। আমরা যখন দোয়া করি তখন আমরা বাস্তবে সমগ্র বিশ্বজগতের মালিক এবং স্রষ্টার সামনে আমাদের আবেদন উপস্থাপন করি এবং তাঁর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহতে বিশ্বাসী একজন মুসলিমের জন্য দোয়ার মাধ্যমে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে কথা বলা মানসিক প্রশান্তিদায়ক ।
যেহেতু আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর সৃষ্টি এবং তিনি যে কোন কিছু করার ক্ষমতা রাখেন, তাই আমাদের ইহকাল ও পরকালের জীবনের সাথে সম্পর্কিত আমাদের প্রতিটি প্রয়োজনের জন্য দোয়া করা উচিত এবং আমাদের দোয়াতে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাকে সম্বোধন করা উচিত। এবং কোরানেও আল্লাহ আমাদের এমনটিই শিখিয়েছেন:
{إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।১:৫}
{তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। যারা আমার এবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে দাখিল হবে লাঞ্ছিত হয়ে।৪০:৬০}
{বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।৩৯:৫৩}
দোয়ার মাধ্যমে মূলত আমরা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন করি।
দোয়াকে মুমিনের অস্ত্র বলা যায় কারণ এটি ঈমান বৃদ্ধি করে, দুস্থদের আশা ও স্বস্তি দেয় এবং প্রার্থনাকারীকে হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করে। এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আল্লাহ আমাদের সমস্ত প্রয়োজন, ইচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষার জন্য তাঁর কাছে ডাকতে উৎসাহিত করেন।
{আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।২:১৮৬}
আল্লাহ আমাদের নিকটেই আছেন , গ্রীবাস্থিত ধমনীর থেকেও নিকটে। আমাদের প্রয়োজনে আমরা যখন ইচ্ছা তাকে ডাকতে পারি , তার কাছে দোয়া করতে পারি। এবং আমরা দৈনন্দিন জীবনে সেটা করে ও থাকি। এর জন্য কোন আনুষ্ঠানিক সময়ের অপেক্ষা করা লাগে না। নদীর মাঝখানে ঝড় উঠলে আমরা কায়মনোবাক্যে আল্লাহকে ডাকি , কোন অঙ্গভঙ্গী করি না। নবী যা-নুন(ইউনুস) মাছের পেটের ভিতর থেকে আল্লাহকে ডেকেছিলেন:
{এবং যা-নুনের কথা স্মরণ করুন তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, অতঃপর মনে করেছিলেন যে, তার উপরে আমার ক্ষমতা নেই। অতঃপর তিনি অন্ধকারের মধ্য থেকে আহবান করলেনঃ তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই; তুমিই মহিমা আমি অন্ধকারাচ্ছন্ন। অতঃপর আমি তাঁর আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাঁকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিলাম। আমি এমনি ভাবে বিশ্ববাসীদেরকে মুক্তি দিয়ে থাকি। ২১:৮৭-৮৮}
পরিশেষে এটাই বলব , ১৪০০ বছর আগে পার্শি ইমামরা সালাতের মানে নামাজ নামক আজকের অনুষ্ঠানিক উপাসনায় পরিবর্তন না করলে , এত কিছু লেখার প্রয়োজন পড়ত না। কোরান বুঝে পড়লেই সালাত কি তা সকলে জানতে পারত। আনুষ্ঠানিক নামাজের ধারনা জন্ম থেকেই আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। তাই কোরান পড়ার সময় আমরা নামাজকেই খুজি , সালাতকে নয়।
খুজলে কি হবে , নামাজের কিছুই কোরানে নেই। হাদিস পুজারী ভাইরা , টেনশন কইরেন না। কয়জনই আর আমার লেখা পড়ে!! বিশ্বের ১২০ কোটি মুসলমানের তুলনায় তা নিতান্তই নগন্য। যারা পড়ছে তাদের জন্যেও নামাজ বাদ দেয়া এত সোজা নয়। আমি কাউকে নামাজ ছাড়তে ও বলি না বা ধরতে ও বলি না , আমি আল্লাহ মনোনীত রাসুল নই। যার যার স্বীদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে।
(সূত্র: বিভিন্ন ওয়েবসাইট)